প্রচন্ড ভয়ে ছুটে চলছি। পেছন থেকে তাড়া করছে ভয়ালদর্শন এক মহিষ। মহিষ টার চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে। প্রচন্ড ক্ষেপে আছে মহিষটি কোন কারনে। ছুটছি তো ছুটছিই। কোন দিকে খেয়াল নেই। ছুটতে ছুটতে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। তারপরও বিরামহীন ভাবে ছুটে চলতে হচ্ছে। হঠাৎ কিছু একটার সাথে পা আটকে গিয়ে পড়ে গেলাম। আসন্ন বিপদ টের পেয়ে সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে লাগল। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিনা। মহিষ টাও একই রকম ভাবে ছুটে আসছে। আর একটু পর কি হবে সেটা কল্পনাও করতে পারছিনা। এমন সময় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে চপ চপ করছে। আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠছে। তিক্ত একটা অনুভূতিতে মনটা বিষিয়ে উঠল। উঠে মোবাইলে দেখলাম রাত ৩ টা ৩৬ বাজে। এখনও সকাল হতে অনেক সময় বাকি আছে। আস্তে আস্তে মশারী থেকে পা বের করে বিছানা থেকে নামলাম। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে জগ থেকে কিছু পানি গলায় ঢাললাম। তারপর রুমে ফিরে এসে আবার শুতে গেলাম। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর বুঝতে পারলাম আর ঘুম আসবে না। আবার উঠে পড়লাম। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুঃস্বপ্নের রেশটা আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগল। গতকালকের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। সারা দিনে কিছুই করতে পারি নি। গত কয়েকটা দিন ধরেই তো কিছু করতে পারছি না। সারাদিন একা একা বসে থাকা আর ভাবনার মধ্যে ডুবে যাওয়া ছাড়া। এভাবে একজন মানুষ বাঁচতে পারে? নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম। কোন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ নাই, শুধু ভার্সিটিতে দেখা হওয়া ছাড়া। তাও ঠিকমত ক্লাস করি না। একা একটা সিটে বসে স্যারদের বোরিং লেকচার শোনা যে কতটা বিরক্তিকর আর যন্ত্রণাদায়ক সেটা আমার চেয়ে ভাল করে আর কেউ বুঝতে পারবেনা। তবুও কিছু করার নাই। এত কাজের ভিড়ে একমাত্র আমারই কোন কাজ নাই। কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। এমন সময় ফজরের আজান শোনা যায়। আজানের ধ্বনিটা এই মুহূর্তে খুব মধুর মনে হয়। আস্তে আস্তে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করে। কাছাকাছি কোথাও কিছু কাক ডেকে উঠে। কাকের কর্কশ ধ্বনি ও এই সময় খুব ভাল লেগে উঠে। আস্তে আস্তে মনটা পবিত্র হয়ে হয়ে উঠল। মিষ্টি একটা বাতাস মাঝে মাঝে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এক চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেল। ভোরের এই অপার্থিব সৌন্দর্যে মনটা ভরে উঠল। এইসময় শীলার কথা মনে পড়ল। ইদানীং আমার সব ভাল মুহূর্তগুলোতে ই তার উপস্থিতি টের পাচ্ছি। ইচ্ছে করছে তার সাথে কথা বলতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। কারন শীলার কোন নাম্বার আমার কাছে নাই।
শীলা আমাদের ভার্সিটির কাছেই একটা কলেজে পড়ে। একদিন ওর কলেজের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একনজর দেখেছিলাম। তাকে দেখতে পাওয়ার মুহূর্তটা স্পষ্ট মনে আছে। কয়েকজন মেয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন অপূর্ব সুন্দরী কিছুটা সময়ের জন্য আমাকে স্থবির করে দিয়েছিল। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন একসাথে ঢেলে তাকে তৈরী করা হয়েছে। পাশের বান্ধবীদের কথা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম ওর নাম শীলা। ওকে সেদিন একনজর দেখার পর থেকেই অসম্ভব ভাল লেগে গিয়েছিল। ওর চোখ, মুখের অবয়ব, কথা বলার ভঙ্গী সব কিছুই আমাকে আশ্চর্য রকম ভাবে আকর্ষিত করছিল। এটাকেই বোধহয় প্রেম বলে। এতদিন ধরে যে ছেলেটা প্রেম করবে না বলে পণ করে এসেছে, আজ হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখার পর থেকে তার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। প্রেম যে কিভাবে নিজের অজান্তে চলে আসে, চিন্তা করে ভেবে পাই না। আস্তে আস্তে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলাম। কল্পনায় শীলার সাথে কথা বলা শুরু করলাম।
একসময় হঠাৎ করে মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠল। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম ৭ টা বেজে গিয়েছে। একটু পরেই ভার্সিটি যেতে হবে। ধ্যান ভেঙ্গে ছুটে গিয়ে মা কে ওঠালাম নাস্তা দেবার জন্য। তারপর প্রাতঃক্রিয়া ও নাস্তা সেড়ে দ্রুত ভার্সিটির পথে রওনা হলাম। প্রতিদিনের মত আজকেও পিছনের বেঞ্চে বসে ক্লাসের ছেলে মেয়েদের কথাবার্তা আচরণ লক্ষ্য করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার এলেন। যথারীতি বোরিং লেকচার শুরু হল। স্যারকে খুব বিরক্তিকর লাগতে শুরু করল। হঠাৎ স্যারের চোখ দুটো রাতে স্বপ্নে দেখা মহিষ টার লাল চোখের মত মনে হতে লাগল। লেকচার তোলার বদলে খাতায় মহিষ টার আদলে স্যারের ছবি আঁকতে শুরু করলাম। একেবারে তন্ময় হয়ে ছবি আঁকছিলাম। হঠাৎ চোখ তুলে দেখলাম স্যার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাড়াতাড়ি করে খাতা লুকাতে গেলাম, কিন্তু ততক্ষণে স্যার দেখে ফেললেন কি করছি। স্যার খুব ক্ষেপে গিয়ে আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ঠিক করলাম আজকে আর কোন ক্লাসই করব না। কি করা যায় ভাবতে লাগলাম।
তখন মনে হল শীলা কে দেখতে যাওয়া যায়। পাশেই ওর কলেজ। তাই চিন্তা করে রওনা দিলাম শীলার কলেজের দিকে। পথে পিচ্চি একটা মেয়ে হাতে ফুল নিয়ে বলল, “স্যার একটা ফুল নিয়া যান, ক্ষিদা লাগছে, কিছু খামু”। অন্য সময় হলে হয়ত এড়িয়ে যেতাম কিন্তু তখন কি ভেবে যেন মেয়েটার হাত থেকে একটা ফুল নিয়ে তাকে ১০ টাকা ধরিয়ে দিলাম। মনের অজান্তে ঠোঁটের এককোণে লাজুক একটা হাসি ফুটে উঠল। ফুলটা নিয়ে আবার রওনা দিলাম। কলেজের ক্যাম্পাসে এসে দেখি অনেক মানুষ। তখন লজ্জা পেয়ে ফুলটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। আজকে শীলা দের কলেজে অনেক ভীড়, কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে মনে হল। গেটের পাশে গিয়ে এককোণে বসে পড়লাম। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন শীলা এই দিক দিয়ে যাবে। কিন্তু অনেকটা সময় বসে থাকার পরও তার কোন দেখা নেই। এই পর্যন্ত চারদিন এখানে এসেছি, কিন্তু সেই প্রথমবারের পরে আর একবারও তার দেখা পাই নি। আজ জেদ চেপে গেল। ঠিক করলাম আজকে না দেখে যাব না। আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম কযেকজন মেয়ে শাড়ি পড়ে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। খেয়াল করলাম তাদের মধ্যে শীলা ও আছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে হয়ত আজ শাড়ি পড়ে এসেছে। আমার দেখা সেই শীলার সাথে মিল খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে গেল। কি অদ্ভূত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। শাড়ি পড়াতে রূপ যেন কয়েকশ গুন বেড়ে গেছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগলাম। কল্পনায় দেখতে পেলাম সে মিষ্টি হাসি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু পরক্ষণেই বাস্তব জগতে ফিরে এসে দেখলাম শীলা আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে গেটের ভেতর ঢুকে চলে গেল। আমি হতাশাগ্রস্থ হয়ে আবার বসে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম, কিভাবে তার সাথে একবার কথা বলা যায়। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একসময় কিছু ভেবে না পেয়ে উঠে বাসার দিকে হাঁটা ধরলাম। মাথার ভেতরটা দপদপ করা শুরু করল। বারবার রাতে স্বপ্নে দেখা মহিষ টার লাল চোখ দুটো ভেসে উঠতে লাগল। দুঃস্বপ্নটা যেন আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে। ঠিক করলাম এখন আর বাসায় ফিরব না। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম লেকের পাড়ে।
লেকের পাড়ে বসে পানির ছোট ছোট ঢেউ দেখতে লাগলাম। মনের ভেতর চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। এভাবে আর কতদিন চলবে? নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই ভেবে পেলাম না। লেকের পাড়ের স্নিগ্ধতার কারনে একসময় মাথার যন্ত্রণাটা কিছুটা কমে আসল। আস্তে আস্তে উঠে বাসার পথে রওনা দিলাম।
বাসায় পৌঁছে খাওয়া দাওয়া সেরে একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। খুব চমৎকার একটা বই, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর ‘মিস্টার মিসন’স উইল’। বইটা পড়তে গিয়ে ইউস্টেসের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে পারলাম না। যখনই অগাস্টার কথা আসছে তখনই শীলার কথা ভেবে মাথার ভেতর যন্ত্রণা করতে শুরু করল। একসময় বইটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। একপাশ হয়ে শোয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বারবার শীলার চেহারা ভেসে উঠছে। সেই সাথে প্রকাণ্ড দুইটা লাল চোখ মাঝে মাঝে শীলা কে কল্পনা থেকে সরিয়ে দিতে লাগল। মনে হতে লাগল চোখ দুটো শীলা কে কোন এক কারনে আমার কাছে আসতে দিতে চাইছে না। মাথার যন্ত্রণাটা আবার বাড়তে শুরু করল। হঠাৎ খেয়াল করলাম চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করছে। বুঝতে পারলাম আমি কাঁদছি। বিছানা থেকে উঠে বসে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইলে রেডিও শুনতে শুনতে আবার শুয়ে পড়লাম। আস্তে আস্তে যন্ত্রণা কমে আসতে শুরু করায় একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। রেডিওতে তখন বেজে চলছে,
You may say that I'm a dreamer
But I'm not the only one
I hope someday you'll join us
And the world will live as one…….
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন