খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ল জাহানারা। আকাশে এখনো সূর্যটা উঠি উঠি করছে। একটু পরেই চারদিক ফর্সা হয়ে উঠবে। জাহানারা ওজু করে ফজরের নামাজ পড়তে বসল। ছেলে যাতে সুস্থ শরীর নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারে সে জন্য স্রষ্টার নিকট বেশ কিছুটা সময় নিয়ে প্রার্থনা করল।
এখনো জাহানারার অনেক গুলো কাজ বাকি পড়ে আছে। নামাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি কাজে হাত দিল। আজ তার ছেলে নীরব, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য ঢাকায় চলে যাচ্ছে। এতদিন যে ছেলেটাকে সামান্য সময়ের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেয় নি, আজ তাকে অনেক দূরে চলে যেতে দিতে হচ্ছে। ভাবতেই ছলছল করে উঠল জাহানারার চোখ দুটো।
তাড়াতাড়ি করে ফ্রিজ থেকে অর্ধেক রান্না করা ইলিশ মাছটা বের করে নিল। নীরব ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করে। গতকাল বিকেলে জাহানারা নিজ হাতে বাজার থেকে ইলিশ মাছটা নিয়ে এসেছে। মাছটা যাতে তাজা থাকে তাই রাতেই অর্ধেক রান্না করে রেখেছিল। সবকিছু ঠিক করে মাছটা রান্না করা শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে আগুনের উত্তাপে পাতিলের গায়ে লেগে থাকা ঝোলগুলো শব্দ করে ছোটাছুটি শুরু করল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জাহানারা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। অতীতের স্মৃতিগুলো আস্তে আস্তে চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হল এইতো সেদিন ঘর আলো করে ফুটফুটে ছেলেটার জন্ম হয়েছিল। প্রথম সন্তান ছেলে হওয়াতে বাড়ির সবাই তখন ভীষন খুশি। মিষ্টি নিয়ে ছোটাছুটি পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাহানারার সেদিকে খেয়াল ছিল না। সে তখন প্রসবের যন্ত্রণা ভুলে ঘুমন্ত ছেলেটার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। একটু আগে এই ছেলেটার জন্ম দিয়েছে সে, এটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না।
আস্তে আস্তে সেদিনের ছোট্ট ছেলেটা বড় হতে লাগল। দুষ্টামি আর বাঁদরামি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখত। জাহানারা নিজে পছন্দ করে তার নাম নীরব রেখেছিল। নীরব নামটা কেন জানি তার খুব পছন্দের ছিল। তখন স্বপ্ন দেখত ছেলেটাকে ডাক্তার বানাবে। আজ অবশ্য ছেলেটা ডাক্তারি পড়ার দিকে না গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাচ্ছে। এ নিয়ে জাহানারা প্রথমে একটু কষ্ট পেলেও এখন কোন আক্ষেপ নেই। এখন তার ভাবনা, ছেলের জন্য ডাক্তার দেখে একটা মেয়ে ঘরে নিয়ে আসবে। ভাবতেই ঘোমটা পড়া লাজুক টাইপের একটা মেয়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে মনে কিছুটা আনন্দ পেল।
আস্তে আস্তে মাছটা হয়ে আসছে। জাহানারা অন্য চুলায় ভাত চড়িয়ে দিল। ঘড়িতে দেখল সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি গেল নীরবকে জাগাতে। সাড়ে সাতটায় ট্রেন, এখন না উঠলে রেডি হতে দেরি হয়ে যাবে।
-নীরব, এই নীরব তাড়াতাড়ি ওঠ বাবা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নীরব একটু নড়ে চড়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
-নীরব, ওঠ বলছি। ট্রেন মিস হয়ে যাবে কিন্তু।
ঘুম জড়িত কণ্ঠে নীরব জবাব দিল,
-কয়টা বাজে আম্মু?
-সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছে।
-আরেকটু ঘুমাই আম্মু? সব তো রেডি করাই আছে।
জাহানারার হঠাৎ করে ছেলেটার জন্য খুব মায়া লাগল। কত আরাম করে ঘুমাচ্ছে। থাক না আর একটু ঘুমিয়ে।
একসময় স্কুলে পাঠানোর জন্য ছেলেটাকে এভাবে জাগাতে হত। হঠাৎ পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। ভীষন জালাতন করত ছেলেটা। ওর বাবা এ নিয়ে সব সময় বকাবকি করত, কিন্তু জাহানারা সব সময় ওকে আদর করে জাগাত। এখন আর তাকে এভাবে জাগাতে হবে না। সব সময় নিজে থেকেই উঠতে হবে। ভাবতেই দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে এল। জাহানারা ঠিক করল, সরাসরি জাগাতে না পারলেও মোবাইলে কল দিয়ে ঠিকই প্রতিদিন জাগিয়ে দেবে।
-ঠিক আছে, কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে উঠে পড়বি।
কথাটা বলে জাহানারা আবার রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। মাছটা থেকে খুব সুন্দর গন্ধ বের হতে শুরু করেছে। জাহানারা মনে মনে খুশি হয়ে উঠল, যাক মসলাপাতি সব ঠিকঠাক আছে তাহলে। ভাত টাও আস্তে আস্তে ফুটতে শুরু করে দিয়েছে। মাছটা নামিয়ে আবার ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ বেজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি করে আবার গেল নীরবকে জাগাতে।
-এই নীরব উঠে পড়, আর জাগাতে পারব না কিন্তু। শেষে ট্রেন মিস করলে আমাকে দোষ দিতে পারবি না।
শেষ পর্যন্ত কাজ হল। নীরব আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসল।
-উফ আম্মু, তুমি খুব বিরক্ত কর। তোমার জন্য শান্তি মত একটু ঘুমাতে পারি না।
বলেই বিরক্তি নিয়ে একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাল, আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে ছুটল। জাহানারা ছেলের চলে যাওয়া দেখে মনে মনে বলল, আর তোকে এভাবে বিরক্ত করতে পারব না। আবার দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে এল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার রান্নাঘরের দিকে ছুটল জাহানারা। ভাতটা মনে হয় হয়ে এসেছে।
আস্তে আস্তে ভাতটা পরীক্ষা করে পাতিলটা নামিয়ে মাড়টা ফেলে দিল। নীরবও হাতমুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে পড়েছে। জাহানারার সাথে মুখোমুখি হতেই মিষ্টি একটা হাসি দিল। জবাবে জাহানারা ও হাসি দিল।
-তাড়াতাড়ি খেতে আয়, টেবিলে ভাত দিয়ে দিচ্ছি।
-আসছি আম্মু, পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।
নীরব গেল তার ব্যাগটা শেষবারের মত গুছিয়ে নিতে। ভাল মত চারদিকে দেখল, কোন জিনিস ফেলে যাচ্ছে কিনা। টাওয়েল টার কথা মনে হতেই ব্যাগে দেখল সেটি নেই।
-আম্মু, আমার টাওয়েলটা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না।
-দাঁড়া দেখছি। মনে হয় বারান্দায় আছে। এনে দিচ্ছি।
বারান্দায় গিয়ে দেখল টাওয়েলটা এখনো শুকায় নি। ভেজা টাওয়েলটা নিয়েই নীরবের রুমে চলে আসল।
-এই নে, এখনো ভাল মত শুকায় নাই। পলিথিনে ভরে নিয়ে নে।
-আর শোন, গিয়েই শুকাতে দিয়ে দিবি।
-ঠিক আছে আম্মু।
সব কিছু গুছিয়ে নীরব ভাত খাওয়ার টেবিলে চলে আসল। টেবিলে ইলিশ মাছ দেখে খুব খুশি হয়ে উঠল।
-ওয়াও! ইলিশ মাছ। থ্যাঙ্কু আম্মু।
জাহানারা মনে মনে খুশি হয়ে উঠে, তার কষ্ট সার্থক হয়েছে। মুখে হাসি নিয়ে ছেলের দিকে তাকাল।
-তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।
নীরব খাওয়া শুরু করলে জাহানারা তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। ছেলেটা খুব মজা করে খাচ্ছে। কতদিন যে ওকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারব না। জাহানারা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সেদিনের পিচ্চি ছেলেটা আজ কত বড় হয়ে গেছে। একসাথে দুইটা মাছ দিতে হত তাকে, না হলে খেতেই বসত না।
-মাছ আরেক টুকরা দেই?
-না আম্মু। যে পরিমাণ কাঁটা আছে, তাতে আরেকটা খেতে গেলে আর ট্রেন ধরতে হবে না।
জাহানারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সময় প্রায় হয়ে এসেছে, তাই আর জোর করল না। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
নীরব ঘড়িতে দেখল সাড়ে ছয়টা বেজে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করতে লাগল। ওদিকে জাহানারা রেডি হওয়ার জন্য চলে গেল।
খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নীরব জাহানারার রুমে চলে আসল। জাহানারা ও রেডি হয়ে নিল।
-আম্মু, তোমার কষ্ট করে যাওয়ার কি দরকার ছিল? আমি একাই তো চলে যেতে পারতাম।
-আরে কোন সমস্যা না, আজকেই তো খালি দিয়ে আসব। তোর আব্বুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নে।
নীরব তার আব্বুর কাছে গিয়ে সালাম করল।
-আব্বু, আমি যাচ্ছি।
-ঠিক আছে, ভাল মত থাকিস। আর গিয়ে একটা ফোন করিস।
-ঠিক আছে আব্বু।
-আমি তোর সাথে যাচ্ছি না, তোর আম্মু যাবে।
-ঠিক আছে, কিন্তু কোন দরকার ছিল না।
আব্বুর সাথে আর কথা না বাড়িয়ে নীরব চলে গেল তার ছোট বোন সুমির রুমে। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে, জাহানারার সাথে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে দুইজন উঠে বসল। ট্যাক্সিতে বসার পর হঠাৎ জাহানারার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার নীরবের খুব জ্বর হয়েছিল। খুব ভয়ানক অবস্থা, বাসায় নীরবের আব্বু ও নেই। জাহানারা বাধ্য হয়ে নিজেই ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে রওনা দিয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে দেখল একটা ট্যাক্সিও নেই। শেষে অনেক্ষণ নীরবকে কোলে নিয়ে হাঁটার পর একটা ট্যাক্সি পেয়েছিল। তখন কত ছোটই না ছিল ছেলেটা। একা কিছুই করতে পারত না। আর আজ কোথায় চলে যাচ্ছে। অসুখ হলে তাকে কে দেখবে? দৃষ্টিটা আবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। না চোখটা আজকে খুব জ্বালাচ্ছে। জাহানারা চোখের উপর কপট রাগ দেখাল।
-ঠিক মত থাকবি, ভাল মত খাওয়া দাওয়া করবি। আর অসুখ যাতে না করে সেই চেষ্টা করবি।
-আম্মু, তুমি এত টেনশন করতেছ কেন? আমি এখনো ছোট আছি নাকি?
-থাক আর পাকামো করতে হবে না। অসুখ হলে তো শুয়ে শুয়ে কাঁদবি, তখন কে তোকে দেখতে আসবে?
-অসুখ হলে সাথে সাথে তোমাকে ফোন করে দিব, তুমি চলে এস।
ট্যাক্সি টা স্টেশনে এসে পৌঁছালে জাহানারা নীরবকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বাহিরে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। নীরব জানালার পাশে বসেছে বলে বাহিরে থেকে জাহানারা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলের সামনে কোনরকম কান্নাকাটি করবে না, আগেই ঠিক করে নিয়েছিল। কিন্তু ধরে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। নীরবের অনুভূতিগুলো বোঝার চেষ্টা করল জাহানারা। ছেলেটা অনেক স্বাভাবিক আছে। কিন্তু ভিতরে যে কষ্ট হচ্ছে সেটা কেউ না বলে দিলেও জাহানারা বুঝতে পারছে। মা ছেলে নির্বাক ভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় শব্দ করে ট্রেন ছেড়ে দিল। জাহানারা শেষবারের মত হাত বাড়িয়ে ছেলেকে আদর করার চেষ্টা করল। ট্রেনটা ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল। জাহানারা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গাল বেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ঝাপসা দৃষ্টিতে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে রইল। নীরবও জানালা দিয়ে মাথা বের করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখ দুটোও ছল ছল করছে। ট্রেনটা একসময় একটা বিন্দুর মত দূরে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর সম্বিত ফিরে পেল জাহানারা।
তখন সুমির কথা মনে পড়ল। মেয়েটাকে তো স্কুলে পাঠাতে হবে। সুমির কথা মনে পড়ায় চিন্তা করল এখন তো সুমি আছে, কিন্তু একসময় সুমিকে ও এভাবে বিদায় জানাতে হবে। তখন সে একা একা কি করবে। এই সন্তান দুটিই ছিল তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। এরা দুজনই যদি দূরে চলে যায়, তাহলে কি নিয়ে বেঁচে থাকবে? কাঙ্খিত বিচ্ছেদেও এত যন্ত্রণা কেন? বাস্তবতা এত কঠিন হয় কেন? এই প্রশ্নগুলো জাহানারা নিজেকেই করল। কিন্তু সে তো এগুলোর উত্তর জানে না। কখনো জানতেও পারবে না। ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে স্টেশন থেকে বের হতে লাগল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন